প্রতীক প্রাণীঃ ঘাসফড়িং (The Grasshopper):
আরশোলার মতো ঘাসফড়িংও একটি অতিপরিচিত পতঙ্গ (insect)। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সবখানে সবুজ শস্যক্ষেত বা সবজির বাগানে বিভিন্ন ধরনের ঘাসফড়িং একা বা দলবদ্ধ হয়ে বিচরণ করে। ঘাসফড়িং-এর কিছু প্রজাতি পঙ্গপাল (locust) নামে পরিচিত। এগুলো বাদামি বর্ণের মাঝারি আকৃতির পতঙ্গ এবং ঝাঁক বেঁধে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও এদের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে মুহুর্তের মধ্যে একটি ক্ষেত্রের সমস্ত ফসল খেয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারে। পঙ্গপাল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের শস্যক্ষেতের জন্য মারাত্মক হুমকি ।
ঘাসফড়িং যেহেতু একটি করে কাইটিনময় বহিঃকংকাল, একটি তিনখণ্ডবিশিষ্ট দেহ (মস্তক, বক্ষ ও উদর), তিনজোড়া সন্ধিযুক্ত পা, জটিল পুঞ্জাক্ষি এবং একজোড়া অ্যান্টেনা বহন করে সে কারণে এদের Insecta শ্রেণিভুক্ত সদস্য বা পতঙ্গ নামে অভিহিত করা হয়। ঘাস ও লতাপাতার মধ্যে থেকে সেখানেই লাফিয়ে লাফিয়ে চলে দেখে এর নাম হয়েছে “ঘাসফড়িং”।
সাড়া পৃথিবীতে এ পর্যন্ত প্রায় এগারো হাজার প্রজাতির ঘাসফড়িং শনাক্ত করা হয়েছে। সাধারণ কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে রয়েছে Schistocerca americana, Romalea microptera,Poekilocerus pictus.
বাসস্থান (Habitat) : ঘাসফড়িং যেহেতু ঘাস, পাতা, শস্য ও শস্যের কচিপাতা আহার করে সে কারণে এমন ধরনের নিচু বসতি এদের পছন্দ। মূলত সব ধরনের বসতিতেই (তৃণভূমি, বারিবন, চারণভূমি, মাঠ, মরুভূমি, জলাভূমি প্রভৃতি) বিভিন্ন প্রজাতির ঘাসফড়িং দেখা যায়। স্বাদুপানির ও ম্যানগ্রোভ জলাশয়ে যেহেতু পানির উঠানামা বেশি হয় এবং ডিম পাড়ার জায়গা প্লাবিত হয়ে যায় সে কারণে এসব বসতিতে ঘাসফড়িং কম বাস করে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় ঘাসফড়িং বিপুল সংখ্যায় পরিযায়ী (migratory) হয়, দিনে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।
খাদ্য (Food) : ঘাসফড়িং তৃণভোজী বা শাকাশী (herbivorous) প্রাণী। ডিম থেকে ফোটার পরপরই, নিম্ফ অবস্থায় ঘাসফড়িং চার পাশের যে কোন ছোট ছোট, সহজপাচ্য গাছ, ঘাস বা নতুন কোমল শাখা-প্রশাখা খেতে শুরু করে । দু'একবার খোলস মোচনের পর একটু বড় হলে শক্ত উদ্ভিজ খাবার গ্রহণ করে। তরুণ ঘাসফড়িং পূর্ণাঙ্গদের মতোই নির্দিষ্ট উদ্ভিজ খাবার গ্রহণ করে। তখন খাদ্য তালিকায় ঘাস, পাতা ও শস্য প্রধান খাবার হিসেবে উঠে আসে। বেশির ভাগ ঘাসফড়িং অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ থেকে আহার সংগ্রহ করে, দু'একটি প্রজাতি সুনির্দিষ্ট উদ্ভিদ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে।
1
2
3
5
ঘাসফড়িং এর শ্রেণিতাত্ত্বিক অবস্থানঃ
Phylum: Arthropoda
Class: Insecta
Subclass: Pterygota
Order: Orthoptera
Family: Acrididae
Genus: Poekilocerus
Species: Poekilocerus pictus
বাহ্যিক অঙ্গসংস্থান (External Morphology):
ঘাসফড়িং-এর দেহ সরু, লম্বাটে, বেলনাকার (cylindrical) এবং দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসম। পূর্ণাঙ্গ প্রাণী লম্বায় ৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেহের রঙ অনেকটা হলদে-সবুজ (yellowish green) ধরনের অথবা বাদামি রঙের মাঝে নানা ধরনের ফোঁটা (spots) বা ডোরাকাটা (markings) হতে পারে। মিশ্রিত এ রঙ তাদের পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে এমনকি শত্রুর হাত থেকেও রক্ষা করতে সাহায্য করে। এছাড়াও কিছু ঘাসফড়িং আছে উজ্জ্বল নীল-হলুদ রঙের (যেমন- Poekilocerus pictus)।
ঘাসফড়িং-এর সারাদেহ কাইটিনযুক্ত কিউটিকল (cuticle)- এ আবৃত। বহিঃকঙ্কাল হাইপোডার্মিস (hypodermis) নিঃসৃত পদার্থে সৃষ্ট এবং প্রত্যেক দেহখন্ডকে স্ক্লেরাইট (sclerite) নামক কঠিন প্লেটের মতো গঠন সৃষ্টি করে। স্কেলেরাইটগুলোর সংযোগস্থল সূচার (suture) নামে পাতলা নরম ঝিল্লিতে আবৃত। সূচারের উপস্থিতির কারণে দেহখণ্ডক ও উপাঙ্গগুলো সহজেই নড়াচড়া করতে পারে। কিউটিকলের ভিতরে ও নিচে নানা ধরনের রঞ্জক পদার্থ (pigments) থাকায় ঘাসফড়িং-এ বর্ণময়তা দেখা যায়।
ঘাসফড়িং-এর দেহ খণ্ডকায়িত এবং অন্যসব পতঙ্গের মতো তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত, যেমন—
ক. মস্তক (Head)- পুঞ্জাক্ষি, অ্যান্টেনা ও মুখোপাঙ্গ বহন করে।
খ. বক্ষ (Thorax)- তিনজোড়া পা ও দুজোড়া ডানার সংযোগ সাধন করে এবং বহন করে।
গ. উদর (Abdomen)- শ্বাসরন্ধ্র বা স্পাইরাকল (spiracle) এবং জনন অঙ্গসমূহ (genitaliae) ধারণ করে।
ক. মস্তক (Head): বাইরে থেকে অখন্ডিত (একক) মনে হলেও মূলত ৬টি ভ্রূণীয় খণ্ডকের (embryonic segments) সমন্বয়ে মস্তক গঠিত। এটি দেখতে নাশপাতি আকৃতির এবং হাইপোগন্যাথাস (hypognathous) ধরনের অর্থাৎ মুখছিদ্র নিম্নমুখী হয়ে মস্তকের নিচে অবস্থান করে। মস্তক একটি ছোট ও স্থিতিস্থাপক গ্রীবার সাহায্যে বক্ষলগ্ন হয়ে দেহের সমকোণে অবস্থান করে। ঘাসফড়িং গ্রীবার মাধ্যমে মস্তককে বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে পারে। মস্তকের বহিঃকঙ্কালের নাম হেড ক্যাপস্যুল (head capsule) বা এপিক্রেনিয়াম (epicranium)। মস্তকের বহিঃকঙ্কাল কয়েকটি অংশে বিভক্ত, যেমন- পৃষ্ঠদেশের ত্রিকোণাকার অঞ্চলটি ভার্টেক্স (vertex), দুপাশে অবস্থিত জেনা (gena), কপালের দিকে চওড়া ফ্রন্স (frons) এবং ফ্রন্সের নিচে আয়তাকার প্লেটটি ক্লাইপিয়াস (clypeus)।
ঘাসফড়িং-এর মস্তক একজোড়া পুঞ্জাক্ষি, তিনটি সরলাক্ষি বা ওসেলি (ocilli), একজোড়া অ্যান্টেনা (antenna) ও এক সেট মুখোপাঙ্গ বহন করে। নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।
১. পুঞ্জাক্ষি (Compound eye) : ঘাসফড়িং (Grasshopper)-এর মস্তকের উভয়দিকে পৃষ্ঠ-পার্শ্বদেশে, ১ম খণ্ডকে একজোড়া পুঞ্জাক্ষি থাকে। এগুলো অবৃন্তক এবং মস্তকের এক বিরাট অংশ দখল করে থাকে। দৃষ্টিশক্তির দিক থেকে ঘাসফড়িং আর্থোপোড অপেক্ষা উন্নত। এরা সম্ভবত রঙিন বস্তুও সঠিকভাবে দেখতে পায়। গঠনগত ও কার্যকারিতার দিক থেকে যে কোনো ঘাসফড়িং-এর পুঞ্জাক্ষি আরশোলা, চিংড়ি প্রভৃতি আর্থোপোড প্রাণীর মতো। অসংখ্য ওমাটিডিয়া (ommatidia)-র সমন্বয়ে একেকটি পুঞ্জাক্ষি গঠিত হয়। ওমাটিডিয়াই পুঞ্জাক্ষির গঠন ও কাজের একক।
২. ওসেলি (Ocelli; একবচনে-occllus) : ঘাসফড়িং-এর দুটি পুঞ্জাক্ষির মাঝখানে তিনটি সরলাক্ষি বা ওসেলি থাকে । প্রত্যেক ওসেলাস পুরু, স্বচ্ছ কিউটিকলনির্মিত লেন্স ও একগুচ্ছ আলোক সংবেদী কোষ নিয়ে গঠিত। প্রতিটি কোষ রঞ্জক পদার্থসমৃদ্ধ। ওসেলাসের তলদেশে মস্তিষ্কে গমনকারী স্নায়ুতন্ডু (nerve libre) অবস্থিত। এর অভ্যন্তরে আলোক সংবেদী কোষ থাকে যারা রেটিনার মতো কাজ করে।
৩. অ্যান্টেনা (Antenna; বহুবচনে-antennae) বা শুঙ্গ : ঘাসফড়িং-এর পুঞ্জাক্ষির সামনে, মাথার দুপাশে দুটি লম্বা অ্যান্টোনি প্রসারিত থাকে। অ্যান্টোনি দুটি সামনে রেখে চলাফেরা করে এবং ইচ্ছামতো এগুলোকে নাড়াতে পারে। এদুটি নাড়িয়ে এরা স্পর্শ, ঘ্রাণ ও শব্দতরঙ্গ অনুভর করে। স্কেল, পেডিসেন্স ও ফ্লাজেলাম-এ তিনটি অংশ নিয়ে প্রত্যেক অ্যান্টেনা গঠিত। পেডিসেল খাটো ও অবিভক্ত। ফ্লাজেলাম বেশ লম্বা ও প্রায় ২৫টি খণ্ডকে বিভক্ত।
৪. মুখোপাঙ্গ (Mouth parts) : মুখের চারদিক ঘিরে অবস্থিত নড়নক্ষম, সন্ধিযুক্ত উপাঙ্গগুলোকে একত্রে মুখোপাঙ্গ বলে। ঘাসফড়িং-এর মুখোপাঙ্গ মস্তকের অঙ্কীয়দেশে অবস্থিত। কচিপাতা বা কাণ্ড চর্বনে ব্যবহৃত হয় বলে ঘাসফড়িং-এর মুখোপাঙ্গকে চর্বন-উপযোগী (chewing) বা ম্যান্ডিবুলেট (mandibulate) মুখোপাঙ্গ বলে। পাঁচটি অংশের সমন্বয়ে মুখোপাঙ্গ গঠিত- ল্যাব্রাম, ম্যান্ডিবল, ম্যাক্সিলা, ল্যাবিয়াম ও হাইপোফ্যারিংক্স।
খ. বক্ষ (Thorax) : মস্তকের পিছনে মাংসল বক্ষ একটি খাটো, সরু ও নমনীয় গ্রীবা (neck)-র সাহায্যে যুক্ত। ঘাসফড়িং-এর বক্ষাঞ্চল তিনটি অংশে বিভক্ত; যথা-অগ্রবক্ষ (prothorax), মধ্যবক্ষ (mesothorax) এবং পশ্চাৎবক্ষ (metathorax)। প্রত্যেক অংশের পৃষ্ঠদেশ টার্গাম (tergum), অঙ্কীয়দেশ স্টার্নাম (stermum) ও পার্শ্বদেশ প্লিউরন (pleuron)-এ গঠিত। এগুলো পাতলা কিউটিকলের পর্দা দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত। অগ্রবক্ষের টার্গাম অংশটি বেশ বড়, চওড়া এবং পিছনে ও পাশে প্রসারিত । এর নাম প্রোনোটাম (pronotum) বক্ষাঞ্চলে রয়েছে শ্বাসরন্ধ্র, ডানা ও পা।
১. শ্বাসরন্ধ্র বা স্পাইরাকল (Spiracle) : বক্ষের অঙ্কীয়-পার্শ্বদেশে দুজোড়া শ্বাসরন্ধ্র বা স্পাইরাকল অবস্থিত। প্রথম জোড়া প্রোনোটামের নিচে অগ্র ও মধ্যবক্ষের মাঝে এবং দ্বিতীয় জোড়া মধ্য ও পশ্চাৎবক্ষের মাঝে অবস্থিত ।
২. ডানা (Wings) : মধ্য ও পশ্চাৎবক্ষের পিঠের দিকে অর্থাৎ টার্গাম ও প্লিউরনের মধ্যবর্তীস্থান থেকে একজোড়া করে মোট দুজোড়া পাতলা কিউটিকল নির্মিত ডানা রয়েছে। ডানাগুলো প্রথম অবস্থায় দ্বিস্তরবিশিষ্ট প্রাচীর হিসেবে থলির মতো সৃষ্টি হয়, পরে পূর্ণাঙ্গ ডানায় পরিণত হয়। প্রত্যেক ডানা অসংখ্য ছোট নালির মতো ও রক্তে পূর্ণ শিরা-উপশিরায় গঠিত। দুজোড়া ডানার গঠন ও কাজ পৃথক ধরনের। মধ্যবক্ষীয় (mesothoracic) ডানা অর্থাৎ সামনের ডানাদুটি বেশ শক্ত, ছোট, সরু এবং কখনও উড়তে সাহায্য করে না। এগুলো পিছনের দুই ডানাকে ঢেকে রাখে। সেজন্য এগুলোকে এলিট্রা (elytra), ডানার আবরণ (wing covers) বা টেগমিনা (tegmina) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পিছনের বা পশ্চাৎবক্ষীয় (metathoracic) ডানাদুটি বেশ বড়, চওড়া, পর্দার মতো (membranous), স্বচ্ছ এবং উড়তে সাহায্য করে। বিশ্রামের সময় পিছনের ডানাজোড়া অগ্র ডানার নিচে গুটানো থাকে।
৩. পা (Legs) : বক্ষের প্রত্যেক অংশে একজোড়া করে মোট তিনজোড়া পা রয়েছে। প্রতিটি পা পাঁচখণ্ডে বিভক্ত। একেবারে গোড়ায় স্থূল, তিনকোণা কক্সা (coxa); এর পরের ত্রিভূজাকার ক্ষুদ্র ট্রোক্যান্টার (trochanter); পরের লম্বা, নলাকার ও দৃঢ় ফিমার (femur); তার পরবর্তী সরু টিবিয়া (tibia); এবং সবশেষে টার্সাস (tarsus) । টার্সাস তিনটি ছোট উপখণ্ডকে বিভক্ত । এগুলোকে টার্সোমিয়ার (tarsomeres) বলে । টার্সাসের মাথায় সূঁচালো নখর (claws) থাকে। এ ছাড়াও প্রত্যেক পায়ের টিবিয়া ও টার্সাস অংশের পার্শ্বদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূঁচালো কাঁটা থাকে। ঘাসফড়িং-এর পা হাঁটা ও আরোহণে ব্যবহৃত হয়। তবে ফিমার অংশ অনেক বড় ও মাংসল গড়নের হওয়ায় এরা লাফিয়ে দূরের পথ অতিক্রম করতে পারে। টিবিয়া ও টার্সাস শক্ত কাঁটাযুক্ত হওয়ায় খাদ্য ধরতে সাহায্য করে।
গ. উদর (Abdomen) : ঘাসফড়িং-এর উদর বেশ লম্বা, সরু এবং ১১টি খণ্ডকে বিভক্ত। প্রত্যেক খণ্ডকের পৃষ্ঠদেশে টার্গাম (tergum) এবং অঙ্কীয়দেশে স্টার্নাম (sternum) থাকে, কোন প্লিউরন থাকে না। ১ম উদরীয় খণ্ডকটি অসম্পূর্ণ; কারণ, এর স্টার্নাম পশ্চাৎবক্ষের সাথে যুক্ত থাকে । এতে শুধু টার্গাম থাকে । ঘাসফড়িং-এর উদরাঞ্চল নিচে বর্ণিত অঙ্গসমূহ বহন করে।
১. টিমপেনাম (Tympanum) : ১ম খণ্ডকের প্রতিপাশে একটি করে পর্দা রয়েছে যা শ্রবণ অঙ্গ বা শ্রবণ থলি (auditory sac)-কে আবৃত রাখে । এর নাম টিমপেনিক পর্দা বা টিমপেনাম ।
২. শ্বাসরন্ধ্র (Spiracle) : ১ম থেকে ৮ম দেহখণ্ডক পর্যন্ত প্রতিটি খন্ডকের পার্শ্বদেশে একজোড়া করে মোট আটজোড়া শ্বাসবন্ধ্র বা স্পাইরাকল থাকে যার প্রথমটি অন্যগুলো হতে আকারে বড় ।
৩. পায়ু ও বহিঃজনন অঙ্গ : ৯ম ও ১০ম উদরীয় খণ্ডকের টার্গাম আংশিকভাবে ও স্টার্নাম পুরোপুরি একীভূত। ১১শ খণ্ডকের টার্গাম পায়ুর উপরে প্লেটের মতো একটি আবরণ (supra anal plate) তৈরি করে। পুরুষ ও স্ত্রী ঘাসফড়িংয়ের উদর অঞ্চলের গঠনে কিছু পার্থক্য দেখা যায় । পুরুষ ঘাসফড়িং-এর ১০ম খন্ডের পেছন দিকের উভয় পাশে একজোড়া ছোট প্রক্ষেপক রয়েছে যা অ্যানাল সারকাস (anal cercus, বহুবচনে anal cerci) নামে পরিচিত। স্ত্রী ঘাসফড়িং-এর ৯ম স্টার্নাম লম্বাকৃতির যা স্ত্রীজননরন্ধ্র ধারণ করে। এদের উদরের শেষ প্রান্তে ৮ম ও ৯ম খন্ড অঙ্কীয়ভাবে একটি নলাকৃতি বিশেষ অঙ্গ তৈরি করে, যার নাম ওভিপজিটর (ovipositor)।
ঘাসফড়িং-এর মুখোপাঙ্গের বিভিন্ন অংশঃ
ল্যাব্রাম (Labrum) : এটি দেখতে অনেকটা চাপা চাকতির মতো এবং উপরের ওষ্ঠ (lip) গঠন করে। রঙ সবুজ, বাদামি বা অন্য ধরনের হতে পারে। এর মাঝ বরাবর অংশে একটি খাঁজ দেখা যায়। খাঁজটি খাবার ধরে রাখতে, ম্যান্ডিবলের দিকে ঠেলে দিতে ও স্বাদ নিতে সাহায্য করে।
ম্যান্ডিবল (Mandible) : মুখছিদ্রের দুপাশে অবস্থিত, তিনকোণা ও কালো বা বাদামি রঙের বেশ শক্ত ও ভিতরের দিকে সুঁচালো করাতের মতো দাঁতযুক্ত দুটি উপাঙ্গের নাম ম্যান্ডিবল বা চোয়াল। খাদ্য কেটে চিবানোয় চোয়াল সাহায্য করে।
ম্যাক্সিলা (Maxilla) : ম্যান্ডিবলের পিছনে ও বাইরের দিকে প্রতিপাশে একটি করে লম্বাকার ম্যাক্সিলা থাকে। প্রত্যেক ম্যাক্সিলা কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত। সবচেয়ে গোড়ার খণ্ডটিকে কার্ডো (cardo) ও এরপর অবস্থিত খণ্ডককে স্টাইপস (stipes) বলে। স্টাইপসের অগ্রভাগে নখের মতো ল্যাসিনিয়া (lacinia) ও ঢাকনির মতো গ্যালিয়া (galea) নামক দুটি খণ্ড পাশাপাশি অবস্থান করে। গ্যালিয়ার পাশে পাঁচ অংশবিশিষ্ট ম্যাক্সিলারি পাল্প (maxillary palp) রয়েছে। এর উপর থাকে সূক্ষ্ণ রোম। খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ, এটি ধরে রাখতে, মুখের ভিতর প্রবেশ করাতে এবং খাদ্য চূর্ণকরণে সাহায্য করা ম্যাক্সিলার কাজ। ম্যাক্সিলারি পাল্প অ্যান্টেনা ও পায়ের অগ্রভাগ পরিষ্কারে অংশ নেয়, খাদ্যবস্তু হরণ প্রতিরোধ করে এবং সংবেদী অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
ল্যাবিয়াম (Labium): ঘাসফড়িং-এর মুখছিদ্রের নিচে মধ্যাংশ বরাবর স্থানে বহুসন্ধিল একটি ল্যাবিয়াম বা অধঃওষ্ঠ রয়েছে। ল্যাবিয়ামকে দ্বিতীয় জোড়া ম্যাক্সিলির প্রতিনিধি মনে করা হয়। এটি মূলত দুটি খণ্ডে বিভক্ত, যথা—মেন্টাম (mentum) সাবমেন্টাম (submentum)। প্রতিপাশে মেন্টামের মুক্ত প্রান্তে দুটি নড়নশীল লিগুলি (ligulae) এবং তিন সন্ধিযুক্ত ল্যাবিয়াল পাল্প (labial palp) থাকে। এটি খাবার ফসকে যাওয়া রোধ করে ও চর্বিত খাদ্য মুখে প্রবেশ করায়। ল্যাবিয়াল পাল্প সংবেদনশীল অঙ্গ হিসেবে কাজ করায় এটি উপযুক্ত খাদ্য নির্বাচনে সাহায্য করে।
হাইপোফ্যারিংক্স (Hypopharynx) : ল্যাব্রামের নিচে ক্ষুদ্র, মাংসল হাইপোফ্যারিংক্স বা উপজিহ্বাটি অবস্থিত। এটি চারদিকে ম্যান্ডিবল, ম্যাক্সিলা ও ল্যাবিয়াম দিয়ে পরিবৃত থাকে। ল্যাবিয়ামের ভিতরের কিনারা থেকে সৃষ্ট একটি ঝিল্লি হাইপোফ্যারিংক্সের অংকীয়তলের সাথে যুক্ত থাকে। খাদ্যবস্তুকে নাড়াচাড়া করে লালার সাথে মেশাতে সাহায্য করাই এর কাজ।
ঘাসফড়িং এর পৌষ্টিকতন্ত্র (Digestive System of Grasshopper): ঘাসফড়িং-এর খাদ্যাভ্যাসের সাথে পৌষ্টিকতন্ত্র অভিযোজিত এবং প্রধান দুটি অংশ নিয়ে গঠিত যথা-পৌষ্টিকনালি ও পৌষ্টিকগ্রন্থি।
পৌষ্টিকনালি (Alimentary Canal) : ঘাসফড়িং-এর পৌষ্টিকনালি সরল প্রকৃতির এবং মুখছিদ্র থেকে পায়ুছিদ্র পর্যন্ত দেহের মধ্যরেখা বরাবর সোজা নালি হিসেবে অবস্থিত। বর্ণনার সুবিধার জন্য পৌষ্টিকনালিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে : স্টোমোডিয়াম, মেসেন্টেরন ও প্রোক্টোডিয়াম।
১. স্টোমোডিয়াম বা অগ্র-পৌষ্টিকনালি (Stomodaeum or Foregut) : এটি মুখছিদ্র থেকে গিজার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত পৌষ্টিকনালির প্রথম অংশ। ভূণীয় এক্টোডার্ম থেকে উদ্ভূত এ অংশটির অন্তঃপ্রাচীর কাইটিন (chitin) নির্মিত শক্ত আবরণে আবৃত। এটি প্রধানত নিচে উল্লেখিত অংশগুলো নিয়ে গঠিত।
ক. মুখছিদ্র (Mouth) : এটি প্রাকমৌখিক প্রকোষ্ঠ (preoral cavity) বা সিবেরিয়াম (cibarium) নামক প্রকোষ্ঠের গোড়ায় অবস্থিত ছিদ্রবিশেষ প্রকোষ্ঠটি মুখোপাঙ্গে বেষ্টিত থাকে ৷
কাজ : সিবেরিয়ামে খাদ্যবস্তু গৃহীত হয় এবং মুখছিদ্র পথে খাদ্য দেহে প্রবেশ করে ।
খ. গলবিল (Pharynx) : মুখছিদ্রটি ছোট নলাকার ও পেশিবহুল গলবিলে উন্মুক্ত।
কাজ : এর মাধ্যমে খাদ্যবস্তু গ্রাসনালিতে প্রবেশ করে ।
গ. গ্রাসনালি (Oesophagus) : এটি গলবিলের পিছনে সরু, সোজা, নলাকার পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট নালি।
কাজ : খাদ্যবস্তু মুখ থেকে বহন করে ক্রপে পৌছে দেয়।
ঘ. ক্রপ : গ্রাসনালি স্ফীত হয়ে মোচাকৃতি থলির মতো ও পাতলা প্রাচীরযুক্ত ক্রপ গঠন করে।
কাজ : খাদ্যবস্তু কিছু সময়ের জন্য এখানে জমা থাকে। ক্রপের সংকোচন প্রসারণে খাদ্য কিছুটা চূর্ণ হয় এবং লালার এনজাইম পরিপাকের সূত্রপাত ঘটায়।
ঙ. গিজার্ড বা প্রোভেন্ট্ৰিকুলাস (Gizzard or Proventriculus) : এটি গ্রুপের পরবর্তী ত্রিকোণাকার বেশ শক্ত, পুরু প্রাচীরবিশিষ্ট এবং অন্তঃপ্রাচীরের কাইটিনময় ছয়টি দাঁত ও ছয়টি অনুলম্ব ভাঁজ নিয়ে গঠিত অংশ। দাঁতের পিছনে চুল ও ছয়টি প্যাড থাকে। এর পরের অংশে থাকে পিছনে প্রসারিত কপাটিকা ।
কাজ : গিজার্ডের দৃঢ় সংকোচন-প্রসারণ খাদ্যকে চূর্ণ করে; প্যাডের চুলগুলো খাদ্যকণাকে মেসেন্টেরনে প্রবেশের সময় ছাঁকনির কাজ করে; এবং কপাটিকাগুলো খাদ্যকে বিপরীত দিকে আসতে বাধা দেয়।
২. মেসেন্টেরন বা মধ্য-পৌষ্টিকনালি বা পাকস্থলি (Mesenteron on Midgut) : গিজার্ডের পর থেকে শুরু করে উদরের মধ্যাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট অংশটি মেসেন্টেরন । এটি ভ্রূনীয় এন্ডোডার্ম স্তর থেকে সৃষ্টি হয় এবং এর অন্তঃপ্রাচীর কিউটিকলের পরিবর্তে পেরিট্রফিক পর্দা (peritrophic mentirane) নামক বৈষম্যভেদ্য পর্দা দিয়ে আবৃত। মেসেন্টেরনের অগ্র ও পশ্চাৎ প্রান্তে পেশির বলয় বা স্ফিংক্টার (sphincter) থাকে। মেসেন্টেরন এবং স্টোমোডিয়ামের সংযোগস্থলে ৬ জোড়া ফাঁপা, লম্বা মোচাকার থলি থাকে। সেগুলো হচ্ছে গ্যাস্ট্রিক সিকা (gastric caeca) বা হেপাটিক সিকা (hepatic caeca)। প্রতিজোড়া হেপাটিক সিকার একটি সামনের দিকে অন্যটি পিছন দিকে প্রসারিত। মেসেন্টেরনের অন্তঃপ্রাচীর স্তম্ভাকার অস্তঃত্বকীয় কোষে (columnar endodermal cells) গঠিত এবং এটি ভাজ হয়ে অসংখ্য ভিলাই (villi) গঠন করে। মেসেন্টেরনের শেষ অংশে অসংখ্য সূক্ষ্ম চুলের মতো এবং হলদে বর্ণের অঙ্গাণু থাকে। এগুলো ম্যালপিজিয়ান নালিকা (malpighian tubules) যা মূলত রেচন অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
কাজ : মেসেন্টেরনের গহ্বর (lumen)-এ খাদ্যবস্তুর পরিপাক ঘটে এবং এর প্রাচীরে অবস্থিত ভিলাই খাদ্যরস শোষণ করে।
৩. প্রোক্টোডিয়াম পশ্চাৎ-পৌষ্টিকনালি (Proctodaeum or Hindgut) :
এটি পৌষ্টিকনালির শেষ অংশ যা ভূণীয় এক্টোডার্ম থেকে উদ্ভূত এবং অন্তঃপ্রাচীর কিউটিকল দিয়ে আবৃত। নিচে বর্ণিত ৪টি অংশ নিয়ে প্রোক্টোডিয়াম গঠিত।
ক. ইলিয়াম (Iluem) : এটি প্যাচবিহীন, চওড়া নলাকার প্রথম অংশ।
কাজ : এর প্রাচীরের মাধ্যমে পরিপাককৃত খাদ্যরস শোষিত হয় ।
খ. কোলন (Colon) : এটি ইলিয়ামের পিছনে অবস্থিত সরু নলাকার অংশ।
কাজ : পাচিত খাদ্যবস্তুর বাকি অংশ পানিসহ শোষিত হয়।
গ. রেকটাম বা মলাশয় (Rectum) : এটি পৌষ্টিকনালির সর্বশেষ স্ফীত ও পুরু প্রাচীরযুক্ত অংশ। এর অন্তঃস্থ প্রাচীরে ছয়টি রেকটাল প্যাপিলা (rectal papilla; বহুবচনে-papillae) নামক অনুলম্ব ভাঁজ রয়েছে।
কাজ : মল থেকে অতিরিক্ত পানি, খনিজ লবণ, অ্যামিনো এসিড শোষণ করা এবং অপাচ্য অংশ সাময়িক জমা রাখা এর কাজ।
ঘ. পায়ুছিদ্র (Anus) : এটি মলাশয়ের শেষপ্রান্তে অবস্থিত ছিদ্রপথ। এটি দশম দেহখণ্ডকের অঙ্কীয়দেশে উন্মুক্ত।
কাজ : অপাচ্য অংশ মল (faeces) হিসেবে দেহ থেকে অপসারণ করে।
পৌষ্টিকগ্রন্থি (Digestive Glands):
ঘাসফড়িং-এর লালাগ্রন্থি, মেসেন্টেরনের অন্তঃআবরণ এবং হেপাটিক সিকা পৌষ্টিকগ্রন্থি হিসেবে কাজ করে। নিচে এসব অংশের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।
১. লালাগ্রন্থি (Salivary glands) : এটি ঘাসফড়িং-এর প্রধান পৌষ্টিকগ্রন্থি। ত্রুপের নিচে ক্ষুদ্র, শাখাপ্রশাখা-যুক্ত একজোড়া লালাগ্রন্থি অবস্থিত। লালাগ্রন্থির নালি ল্যাবিয়ামের গোড়ায় গলবিলে উন্মুক্ত হয়।
কাজ : লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারস (saliva) খাদ্য গলাধঃকরণ ও চর্বণে সাহায্য করে। কিছু শর্করা জাতীয় খাদ্য পরিপাকেও এটি ভূমিকা পালন করে।
২. মেসেন্টেরন বা মধ্য-পৌষ্টিকনালির অন্তঃআবরণ : মেসেন্টেরনের অন্তঃপ্রাচীরে বেশ কিছু ক্ষরণকারী কোষ (secretary cells) আছে যা থেকে পাচকরস ক্ষরিত হয়।
কাজ : ক্ষরিত পাচকরস খাদ্য পরিপাকে অংশ নেয়।
৩. হেপাটিক সিকা (Hepatic caeca) : অগ্র ও মধ্য-পৌষ্টিকনালির সংযোগস্থলে অবস্থিত কোণ (cone) আকৃতির ছয়জোড়া লম্বা স্বচ্ছ নালিকাকে হেপাটিক বা গ্যাস্ট্রিক সিকা বলে।
কাজ : হেপাটিক সিকার অন্তঃপ্রাচীরে অবস্থিত ক্ষরণকারী কোষ থেকে পাচকরস ক্ষরিত হয়ে খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে।
খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক (Feeding & Digestion):
খাদ্য : ঘাসফড়িং সম্পূর্ণ তৃণভোজী বা শাকাশী (herbivorous) প্রাণী। ঘাস, শস্যদানা, লতা-পাতা খেয়ে এরা জীবনধারণ করে। এদের খাবারে শর্করা, আমিষ ও স্নেহজাতীয় সমস্ত উপাদানই থাকে।
খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতি : ঘাসফড়িংয়ের যে মুখোপাঙ্গ তা শুধু চিবানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই এদের খাদ্য গ্রহণকে চর্বণ (chewing) এবং মুখোপাঙ্গকে চর্বণ-উপযোগী বা ম্যান্ডিবুলেট (chewing or mandibulate) মুখোপাঙ্গ বলে। ঘাসফড়িং প্রথমে ম্যাক্সিলারি ও ল্যাবিয়াল পাল্পের সাহায্যে খাদ্য নির্বাচন করে। অগ্রপদ, ল্যাব্রোম এবং ল্যাবিয়াম খাদ্যবস্তু আটকে ধরে। ম্যান্ডিবল ও ম্যাক্সিলি খাদ্যবস্তুর ক্ষুদ্র অংশ কেটে চোষণ করে।
পরিপাক : খাদ্য প্রাকমৌখিক প্রকোষ্ঠে পৌঁছার পরই লালাগ্রন্থি নিঃসত লালারস-এর সাথে মিশিতে হয়। লালারসে অ্যামাইলেজ, কাইটিনেজ ও সেলুলেজ এনজাইম থাকে যা বিভিন্ন শর্করাকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করে। খাদ্যবস্তু প্রাকমৌখিক প্রকোষ্ঠ থেকে ক্রপে পৌছায়, এখান থেকে গিজার্ডে প্রেরিত হয়। আংশিক পরিপাককৃত খাদ্য গিজার্ডে প্রবেশ করলে কাইটিনময় দাঁতে পিষ্ট হয়ে অতি সূক্ষ্ম কণাসমৃদ্ধ পেস্ট (paste)-এ পরিণত হয়। এগুলো গিজার্ডে অবস্থিত সূক্ষ্ণ রোমে পরিস্রত হয়ে মেসেন্টেরনে প্রবেশ করে । মেসেন্টেরনের অন্তঃর্গাত্র এবং হেপাটিক সিকা ক্ষরণ ও শোষণতলরূপে কাজ করে। মেসেন্টেরনে মলটেজ, ট্রিপটেজ, অ্যামাইলেজ, ইনভার্টেজ, লাইপেজ প্রভৃতি এনজাইমের উপস্থিতিতে খাদ্যবস্তু সরল, তরল খাদ্যরসে পরিণত হয়। পরিপাককৃত খাদ্য মেসেন্টেরনের কোষীয় প্রাচীরের মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে হিমোসিলে প্রবেশ করে সারা দেহে পরিবাহিত হয়। অজীর্ণ খাদ্যবস্তু কোলনের ভিতর দিয়ে মলাশয়ে পৌছার আগেই কোলনের প্রাচীর তা থেকে পানি, লবণ, অ্যামিনো এসিড ও অজৈব আয়ন শোষণ করে নেয়। পরে কঠিন অপাচ্য বস্তু মলরূপে পায়ু পথে বাইরে নির্গত হয় ।
ঘাস ফড়িং এর রক্ত সংবহন তন্ত্রঃ দেহের প্রয়োজনীয় উপাদান, পুষ্টি প্ৰবা, হরমোন ইত্যাদি রক্তের মাধ্যমে দেহকোষে পৌছানো এবং দেহকোষ বিপাকে সৃষ্ট বর্জ্য একইভাবে রেচন অঙ্গে নিয়ে আসার প্রক্রিয়ার নামই সংবহন। রক্তের পথ অনুসারে প্রাণিদেহে ২ ধরনের দেখা যায়, যেমন-মুক্ত (open) বা ল্যাকুনার (lacunar) বদ্ধ সংবহনতন্ত্র।
মুক্ত সংবহন : যে সংবহনতন্ত্রে রক্ত হৃদ্যন্ত্র থেকে নালিকা পথে বের হয়ে উন্মুক্ত দেহগহ্বরে প্রবেশ দেহগহ্বর থেকে পুনরায় নালিকা পথে হৃদ্যন্ত্রে ফিরে আসে তার নাম মুক্ত সংবহন। অর্থাৎ রক্ত সবসময় র মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় না। চিড়িং, পতঙ্গ, মলাস্কা প্রভৃতি প্রাণীর দেহে এ ধরনের সংবহন দেখা যায়। বন্ধ সংবহন : যে সংবহনতন্ত্রে রক্ত সবসময় রক্তবাহিকা ও হৃদ্যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আবদ্ধ থেকে প্রবাহিত কখনোই দেহ গহ্বরে যুক্ত হয় না তাকে বলে বন্ধ সংবহন। অ্যানিলিড জাতীয় অমেরুদন্ডী প্রাণিদেহে এবং সকল মেরুদণ্ডীয় প্রাণীতে এ ধরনের সংবহন দেখা যায়।
ঘাসফড়িং-এর রক্ত সংবহনতন্ত্র অনুন্নত ও মুক্ত ধরনের এবং তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত হিমোসিল, হিমোলিক ও পৃষ্ঠীয় বাহিকা। নিচে এসব অংশের বর্ণনা দেয়া হলো।
ক. হিমোসিল (Haemocoel; গ্রিক, haima = রক্ত + koiloma = গহ্বর ) : ভ্রূণীয় পরিস্ফুটনের সময় প্রধান সিলোমিক গহ্বর ব্লাস্টোসিলের সঙ্গে একীভূত হয়ে যে নতুন গহ্বরের সৃষ্টি করে তাকে হিমোসিল বা মিক্সোসিল (mixocoel) বলে। হিমোসিল তখন মেসোডার্মাল পেরিটোনিয়ামের পরিবর্তে বহিঃকোষীয় মাতৃকায় (extra cellular matrix) আবৃত থাকে। এটি রক্তপূর্ণ থাকে। ঘাসফড়িং-এর হিমোসিল দুটি অনুগ্রস্থ পর্দা (diaphragm) দিয়ে তিনটি প্রকোষ্ঠ বা সাইনাস (sinus)-এ বিভক্ত। হৃৎযন্ত্রের তলদেশ বরাবর অবস্থিত। পর্দাকে পৃষ্ঠীয় পর্দা এবং স্নায়ুরজ্জুর ঠিক উপরে বিস্তৃত পর্দাকে অঙ্কীয় পর্দা বলে। এদের উপস্থিতির ফলে সৃষ্ট সাইনাস-তিনটি নিম্নরূপ-
i. পেরিকার্ডিয়াল সাইনাস (Pericardial sinus) এটি পৃষ্ঠীয় পর্দার ঠিক উপরে অবস্থিত। এতে হৃদ্যন্ত্র অবস্থান করে।
ii. পেরিভিসেরাল সাইনাস (Perivisceral sinus) এটি পৃষ্ঠীয় পর্দার নিচে অবস্থিত এবং পৌষ্টিকনালিকে ধারণ করে।
iii. পেরিনিউরাল সাইনাস (Perineural sinus): এটি অঙ্কীয়,
পর্দার নিচে অবস্থিত গহ্বর। এতে স্নায়ুরজ্জু অবস্থান করে। পর্দাগুলো ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় রক্ত প্রয়োজন মতো এক সাইনাস থেকে অন্য সাইনাসে যাতায়াত করতে পারে। অভীয় পর্দাটি পায়ের ভিতরেও বিস্তৃত।
কাজ : হিমোসিল দেহের বিভিন্ন অঙ্গ, রক্ত ও লসিকা ধারণ করে। এর মাধ্যমে খাদ্যরস ও বর্জ্যবস্তু পরিবাহিত হয়।
খ. হিমালিম্ফ (Haemolymph) বা বর্ণহীন প্লাজমা এবং এর মধ্যে ভাসমান অসংখ্য বর্ণহীন রক্তকণিকা বা হিমোসাইট (haemocyte) নিয়ে ঘাসফড়িং-এর রক্ত গঠিত। রঙ হিমোসিল নামক গহ্বরে লসিকা (lymph)-র সাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে বলে ঘাসফড়িংসহ বিভিন্ন পতঙ্গের রক্তকে হিমোলিক বলে। হিমোগ্লোবিন বা অন্য কোন ধরনের স্থাসবন্ধক না থাকায় এর রক্ত বর্ণহীন, শ্বসনে তেমন কোন ভূমিকা রাখে না।
কাজ: খাদ্যসার, রেচনন্দ্রা, হরমোন ইত্যাদি পরিবহনে; অ্যামিনো এসিড, কার্বোহাইড্রেট প্রভৃতি জমা রাখা, জীবাণু ধ্বং করা, তঞ্চনে সাহায্য করা এবং ডানার সঞ্চালন ও খোলস মোচনে সহায়তা করা হিমোলিকের কাজ।পৃষ্ঠীয় বাহিকা (Dorsal vessel) : দেহের মধ্য-পৃষ্ঠীয় অবস্থানে রক্ষিত এটি প্রধান স্পন্দনশীল অঙ্গ। এ অঙ্গ দুটি অংশে বিভক্ত- (i) অস্ট্রিয়াবিহীন সোজা নলাকার সম্মুখ ও পশ্চাৎ অ্যাওর্টা এবং (i) হৃদযন্ত্র । ঘাসফড়িং-এ একটি লম্বাটে, নলাকার হত্যপ্ত থাকে। এটি বক্ষ ও উদরীয় অঞ্চলের পৃষ্ঠদেশে মাঝ বরাবর যে গহ্বরে থাকে তাকে ... পেরিকার্ডিয়াল সাইনাস (pericardial sinus) বলে। হৃদ্যন্ত্রটি সাতটি ফানেল আকার প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। প্রতিটি প্রকোষ্ঠে পার্শ্বীয় দিকে একটি করে মোট একজোড়া ছিদ্র বিদ্যমান। ছিদ্রগুলোকে অস্টিয়া (ostia, একবচনে- ostium) বলে। অস্টিয়ামে কপাটিকা (valve) থাকে, যা রক্তকে হৃদযন্ত্রে কেবলমাত্র প্রবেশ করতে দেয় কিন্তু বের হতে দেয় না। টারগামের অক্ষীয় তলের দুপাশ থেকে অ্যালারি পেশি (alary muscle) নামক ত্রিকোণাকার পাখার মতো বিশেষ ধরনের পেশি উৎপন্ন হয়ে পেরিকার্ডিয়াল সাইনাসের প্রাচীরে যুক্ত হয় এবং হৃদযন্ত্রের পার্শ্বীয়-অঙ্কীয় দেশেও যুক্ত থাকে। ঘাসফড়িংয়ে ৬ জোড়া অ্যালারি পেশি থাকে। এদের সংকোচন প্রসারণ রক্ত সংবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রক্ত সংবহন প্রক্রিয়া (Mechanism of Blood Circulation) হৎযন্ত্র ও অ্যালারি পেশির সংকোচন-প্রসারণের ফলেই ঘাসফড়িং-এর দেহের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্ত প্রবাহিত হয়। প্রত্যন্ত্রের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ ক্রমাগত ঢেউয়ের মতো সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়। ঘাসফড়িং-এর হৃদযন্ত্রের স্পন্দন প্রতি মিনিটে ১০০ থেকে ১১০ বার। রক্ত সংবহন প্রক্রিয়াটি নিম্নোক্তভাবে সম্পাদিত হয়।ঘাসফড়িংয়ের রক্তকে হিমোলিম্ফ (haemolymph) বলে। হিমোলিম্ফ পৃষ্ঠীয় অঙ্গসমূহ
(ক) রক্তরস (Plasma): এটি বর্ণহীন তরল। এর 70% ই পানি। এতে মস্তকের সাইনাস অবস্থায় থাকে।
(খ) রক্তকণিকা (Haemocytes): ঘাসফড়িংয়ের রক্তরসে হিমোসাইট নামক বর্ণহীন শ্বেতকণিকা থাকে। এদের প্রতি ঘন মিমি রক্তে 15-60 হাজার হিমোসাইট থাকে। ঘাসফড়িংয়ের রক্তে কোনো পেরিভিসেরাল শ্বসন রঞ্জক থাকে না। হিমোসাইট তিন ধরনের হয়, যথা- প্রোহিমোসাইট (23%), ট্রানজিশনাল হিমোসাইট (68%) এবং বৃহৎ হিমোসাইট (9%)। Amold (1972) এর মতে ঘাসফড়িংয়ের রক্তরসে প্রোহিমোসাইট প্লাজমাটোসাইট, গ্রানুলোসাইট এবং স্কেরিওল কোষ নামক চার ধরনের হিমোসাইট থাকে। ঘাসফড়িংয়ের রক্তকণিকায় কোনো শ্বসন রঞ্জক থাকে না।
অ্যালারি পেশির সংকোচনের ফলে রক্ত পেরিকার্ডিয়াল সাইনাস থেকে অস্টিয়ার মাধ্যমে হৃদ্যন্ত্রে প্রবেশ করে। পরে কাছে পর্যায়ক্রমে পিছন দিক থেকে সামনের দিকে সংকুচিত হওয়ায় রক্ত সম্মুখে প্রবাহিত হয় এবং অ্যাওর্টার ভিতর দিয়ে মোগিলে পৌঁছে। অস্টিয়ায় কপাটিকা থাকায় রক্ত প্রত্যন্ত্র থেকে বাইরে আসতে পারে না। একইভাবে হৃদ্যন্ত্রের প্রকোষ্ঠসমূহের সংযোগস্থলে কপাটিকা থাকায় রক্ত পিছনের দিকে প্রবাহিত হতে পারে না। রক্ত প্রথমে মস্তকে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে পিছন দিকে প্রবাহিত হয়। হৃত্যন্ত্র যখন আবার প্রসারিত হয় তখন হিমোসিল হতে পেরিকার্ডিয়ামের প্রাচীরের ছিদ্রপথে রক্ত পেরিকার্ডিয়াল সাইনাসে ফিরে আসে। ঘাসফড়িং-এর সমাদেহে একবার রক্তপ্রবাহ সম্পন্ন হতে ৩০ থেকে ৬০ মিনিট সময় লাগে।
ঘাসফড়িং এর শ্বসনতন্ত্রঃ অন্যান্য স্থলচর পতঙ্গের মতো ঘাসফড়িংও শ্বসনের জন্য বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। এদের শ্বসনতন্ত্র বেশ উন্নত হওয়ায় রক্তের অক্সিজেন বহনে অক্ষমতার ঘাটতি অনেকখানি পূরণ হয়েছে। ট্রাকিয়া নামক এক ধরনের সুক্ষ্ণ শ্বাসনালির শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে পরিবেশ গৃহীত অক্সিজেন সরাসরি দেহকোষে প্রবেশ করে এবং দেহকোষে উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাইড একই পথে দেহনির্গত হয়। শ্বসন সম্পাদনের জন্য ট্রাকিয়া ও এর শাখা-প্রশাখাগুলো পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে ঘাসফড়িং-এ যে বিশেষ ধরনের শ্বসনতন্ত্র সৃষ্টি করেছে, তার নাম ট্রাকিয়ালতন্ত্র (trachaeal system)। ঘাসফড়িং-এর ট্রাকিয়ালতন্ত্র (শ্বসনতন্ত্র) নিচে বর্ণিত ৪ টি অঙ্গ নিয়ে গঠিত।
১. শ্বাসরন্ধ্র বা স্পাইরাকল (Spiracle) : এগুলো ট্রাকিয়ালতন্ত্রের উন্মুক্ত ছিদ্রপথ। ঘাসফড়িং-এর দেহের উভয় পাশে মোট দশজোড়া শ্বাসরন্ধ্র রয়েছে। এর মধ্যে দুজোড়া বক্ষীয় অঞ্চলে এবং আটজোড়া উদরীয় অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিটি শ্বাসরন্ধ্র ডিম্বাকার ছিদ্রবিশেষ এবং পেরিট্রিম (peritreme) নামক কাইটিননির্মিত প্রাচীরে পরিবেষ্টিত থাকে। রন্ধ্রগুলোর মুখে সূক্ষ্ন রোমযুক্ত ছাঁকনি যন্ত্র (filtering apparatus) থাকায় ধূলাবালি, জীবাণু, পানি ইত্যাদি ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। পেশি নিয়ন্ত্রিত কপাটিকার সাহায্যে রন্ধ্রগুলো খোলে বা বন্ধ হয়। শ্বাসরন্ধ্র বন্ধ থাকলে দেহ থেকে জলীয় বাষ্প বেরোতে পারে না।
২. শ্বাসনালি বা ট্রাকিয়া (Tracheae) : প্রতিটি শ্বাসরন্ধ্র অ্যাট্রিয়াম (atrium) নামক একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে উন্মুক্ত। এখান থেকেই উৎপন্ন হয় সূক্ষ্ণ শাখা-প্রশাখাযুক্ত, স্থিতিস্থাপক, বহিঃত্বকীয় (ectodermal) ট্রাকিয়া যা ঘাসফড়িং-এর প্রধান শ্বসন অঙ্গ এবং সারাদেহে জালিকাকারে বিস্তৃত। ট্রাকিয়া ত্বকের অস্তঃপ্রবর্ধক হিসেবে গঠিত হয়। এদের প্রাচীর তিন স্তরবিশিষ্ট। বাইরের এপিডার্মিস গঠিত ভিত্তিঝিল্লি (basement membeine), মাঝখানে চাপা বহুভূজাকার কোযে গঠিত এপিথেলিয়াম (epithelium) এবং ভিতরের কিউটিকল নির্মিত ইন্টির্মা (intima)। ট্রাকিয়ার অন্তঃস্থ গহ্বর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়। এ গহ্বরে কিছুটা পরপর ইন্টিমা পুরু হয়ে আংটির মতো বলয় গঠন করে। এগুলোর নাম টিনিডিয়া (ctenidia)। টিনিডিয়া থাকায় ট্রাকিয়া কখনও চুপসে যায় না। দেহে ট্রাকিয়া জালিকাকারে বিন্যস্ত থাকলেও প্রধান কয়েকটি নালি অনুদৈর্ঘ্য ও অনুপ্রস্থ বিন্যস্ত থাকে। এগুলোকে ট্রাকিয়াল কাণ্ড (tractical trunk) বলে। মোট তিনজোড়া অনুদৈর্ঘ্য ট্রাকিয়াল কাণ্ড দেহের দৈর্ঘ্য বরাবর বিস্তৃত থাকে। যেমন-
একজোড়া পার্শ্বীয় অনুদৈর্ঘ্য ট্রাকিয়াল কাণ্ড (lateral longitudinal tracheal trunk),
একজোড়া পৃষ্ঠীয় অনুদৈর্ঘ্য ট্রাকিয়াল কাণ্ড (dorsal longitudinal tracheal trunk) এবং
একজোড়া অক্ষীয় অনুদৈর্ঘ্য ট্রাকিয়াল কাণ্ড (ventral longitudinal tracheal trunk)
দেহের প্রতিপাশে অবস্থিত পার্শ্বীয় ট্রাকিয়াল কাণ্ড থেকে পৃষ্ঠীয় ও অঙ্কীয়দিকে কতগুলো অনুগ্রন্থ ট্রাকিয়াল কাণ্ড (transeverse tracheal trunk) সৃষ্টি হয়ে যথাক্রমে পৃষ্ঠীয় ও অঙ্কীয় ট্রাকিয়াল কান্ডকে যুক্ত করে। ট্রাকিয়া সমগ্র দেহে শ্বসনিক গ্যাস পরিবহন করে।
৩. ট্রাকিওল (Tracheole) : ট্রাকিয়া থেকে ট্রাকিওল নামে সুক্ষ্ণ শাখা সৃষ্টি হয়। এগুলো এককোষী নালিকা, মাত্র ১μm ব্যাসবিশিষ্ট, প্রাচীর ইন্টিমা ও টিনিডিয়াবিহীন কিন্তু এগুলোর অভ্যন্তর টিস্যুরসে পূর্ণ থাকে। এ টিস্যুরসই অন্যান্য প্রাণীর রক্তের মতো শ্বসনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। এ রসের মাধ্যমে দেহকোষে গ্যাসীয় আদান-প্রদান ঘটে।
৪. বায়ুথলি (Air sac) : ট্রাকিয়ার কিছু শাখা প্রসারিত হয়ে বড় ইন্টিমাবিহীন ও পাতলা প্রাচীরযুক্ত বায়ুথলি গঠন করে। এসব থলিতে বাতাস জমা থাকে এবং শ্বসনের সময় বায়ু প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
শ্বসন পদ্ধতিঃ শ্বাসরঞ্জক না থাকায় ঘাসফড়িং-এর রক্ত শ্বসনে তেমন ভূমিকা পালন করতে পারে না। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জালিকার মতো ছড়িয়ে থাকা ট্রাকিয়া ও ট্রাকিওলের মাধ্যমে গ্যাসীয় বিনিময় ঘটে। শ্বাসগ্রহণ ও শ্বাসত্যাগ উভয় প্রক্রিয়া প্রধানত শ্বাসবন্ধ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। পেশির কার্যকারিতায় উদূরের ছন্দময় সংকোচন-প্রসারণের ফলে বায়ু (O2) দেহে প্রবেশ করে এবং ট্রাকিয়ালতন্ত্র থেকে বায়ু (CO2) বেরিয়ে আসে। এই
ক. শ্বাসগ্রহণ বা প্রশ্বাস (Inspiration) : পেশির প্রসারণে উদরীয় খণ্ডকগুলো প্রসারিত হলে ট্রাকিয়ার অন্তঃস্থ গহ্বরেও আয়তনে বৃদ্ধি পায়। এ সময় প্রথম চারজোড়া শ্বাসরন্ধ্র অর্থাৎ প্রশ্বাসী শ্বাসরন্ধ্রগুলো (inhalatory - spiracle) খুলে যায় ফলে O2 যুক্ত বায়ু প্রথমে শ্বাসরন্ধ্রের মাধ্যমে ট্রাকিয়ায় পৌঁছে, পরে সেখান থেকে ট্রাকিওল (টিস্যুরসে দ্রবীভূত হয়) ও বায়ুথলির মাধ্যমে অন্তঃকোষীয় স্থানে পৌঁছায়।
খ. শ্বাসত্যাগ বা নিঃশ্বাস (Expiration) : দেহকোষে বিপাকের ফলে সৃষ্ট CO2 ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বায়ুথলি ও ট্রাকিওল হয়ে ট্রাকিয়ায় প্রবেশ করে। এসময় পেশির সংকোচনে উদরীয় খণ্ডকগুলো সংকুচিত হলে ট্রাকিয়ার অন্তঃস্থ গহ্বরের আয়তন কমে যায় এবং বাকি ছয়জোড়া শ্বাসরন্ধ্র অর্থাৎ নিঃশ্বাসী শ্বাসবন্ধুগুলো (exhalatory spiracle) খুলে যায়। ফলে ট্রাকিয়ায় অবস্থিত CO2 সজোরে শ্বাসরন্ধ্র পথে বাইরে নির্গত হয়।
ঘাসফড়িং এর রেচনতন্ত্রঃ আমিষজাতীয় খাদ্য বিপাকে সৃষ্ট নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের প্রক্রিয়ার্কে রেচন (excretion) বলে।
রেচন তন্ত্র (Excretory System ) অন্যসব পতঙ্গের মতো ঘাসফড়িং-এর প্রধান রেচন অঙ্গ ও ম্যাসপিজিয়ান নালিকা (malpighian tubule)। তবে কিছু কোষ অর্থাৎ ইউরেট কোষ, ইউরিকোজ গ্রন্থি, নেফোসাইট এবং কিউটিকল অতিরিক্ত রেচন অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
নামকরণ: Marvello Malpighi | 1628-1694) নামক এক ইতালীয় চিকিৎসক ও জীববিজ্ঞানী সর্বপ্রথম ১৬৬৯ সালে এ নালিকা আবিষ্কার করলে তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়।
অবস্থান: মধ্য ও পশ্চাৎ- পৌষ্টিকনালির সংযোগস্থলে অসংখ্য সুতার মতো ম্যালপিজিয়ান নালিকা হিমোসিলে থাকে। এগুলোর মুক্ত প্রাপ্ত বন্ধ এবং হিমোসিল গহ্বরে হিমোলিখের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। অন্যপ্রান্ত পৌষ্টিকনালি র গহ্বরে উন্মুক্ত।
গঠনঃ ম্যালপিজিয়ান নালিকা একস্তরবিশিষ্ট এপিথেলিয়াম কোষে গঠিত। বাইরের দিকে একটি বেসমেন্ট পর্দা (basement membrane) - এবং ভিতরের দিকে অসংখ্য মাইক্রোভিলাই (microvilli) দিয়ে আবৃত। মাইলো ওলাই বলা সম্মিলিতভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্রাশ কার (brush border) গঠন করে নালিকাগুলো নিজে অতটা নড়নক্ষম নয় বরং হিমোসিলে হিমোলিক্ষের আন্দোলনে এরা রেচন সম্পন্ন করে।
রেচন প্রক্রিয়া : ম্যালপিজিয়ান নালিকার বন্ধ প্রান্ত হিমোলিম্ফে ভাসমান অবস্থায় থেকে রক্ত হতে পানি ও কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। অতঃপর পটাসিয়াম ইউরেট নালিকার কোষের মধ্যে পানি ডাইঅক্সাইডের সাথে বিক্রিয়া করে, পটাসিয়াম বাই-কার্বনেট ও ইউরিক এসিড তৈরি করে। পটাসিয়াম বাইকার্বনেট ও পানি পুনঃশোষিত হয়ে হিমোলিক্ষে ফিরে আসে। কিন্তু ইউরিক এসিড নালিকার গহ্বর বা লুমেন (lumen)-এ থেকে এই ইউরিক এসিড সিলিয়ার আন্দোলনের ফলে ম্যালপিজিয়ান নালিকার গোড়ার অংশ হয়ে পৌষ্টিকনালিতে প্রবেশ করে এবং পশ্চাৎঅস্ত্রে গমন করে। মলাশয়ে অবস্থানকালে- ইউরিক এসিড থেকে অতিরিক্ত পানি পরিশোষণের ফলে বিশুষ্ক ইউরিক এসিড দানী হিসাবে মলের সাথে বেরিয়ে যায়।
অতিরিক্ত বা আনুষাঙ্গিক রেচন অঙ্গ (Accessory Excretory Organ)
১. ফ্যাটবডি কোষ (Fatbody cell) : হিমোসিলের অধিকাংশ স্থান জুড়ে মেদপুঞ্জ বা ফ্যাটবডি থাকে। কয়েক ধরনের কোষ থাকলেও ইউরেট কোষ (urate cell) হিমোসিল থেকে রেচন দ্রব্য শোষণ করে আজীবন এতেকোষাভান্তরে জমা রাখতে সক্ষম।
২. ইউরিকোজ গ্রন্থি (Uricose glands) : পুরুষ ঘাসফড়িংয়ের মাশরুম গ্রন্থিতে ইউরিকোজ গ্রন্থি অবস্থান করার হিমোসিল থেকে রেচন দ্রব্য শোষণ করে ইউরিক এসিডরূপে জমা করে। সংগমের সময় এসব বর্জ্য শুক্রাণুর সাথে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।
৩. নেফ্রোসাইট (Nephrocyte) : পেরিকার্ডিয়াল সাইনাসে হৃদ্যন্ত্রের পার্শ্বদেশে অবস্থিত নেফ্রোসাইট রেচন দ্রব্য সংগ্রহ করে রক্তের মাধ্যমে নিষ্কাশন করে।
৪. কিউটিকল (Cuticle) : লিম্ফ দশায় হিমোসিলে ভাসমান অ্যামিবা সদৃশ কিছু অ্যামিবোসাইট কোষ রক্ত থেকে রেচন দ্রব্য সংগ্রহ করে কিউটিকলের নিচে সঞ্চয় করে। খোলস মোচনের সময় পুরাতন কিউটিকলসহ সঞ্চিত রেচন দ্রব্য পরিত্যক্ত হয়।
ঘাসফড়িংয়ের পুঞ্জাক্ষি (Compound eye):
ঘাসফড়িংয়ের মস্তকের উভয় পাশে কালাে, বৃন্তহীন, বৃক্কাকার, উত্তল গঠনকে পুঞ্জাক্ষি বলে।
প্রতিটি পুঞ্জাক্ষি প্রায় ১২০০ থেকে ১৮০০ টি দর্শন একক বা ওমাটিডিয়াম (Ommatidium) নিয়ে গঠিত। পুঞ্জাক্ষিতে অবস্থিত প্রতিটি ওমাটিডিয়ামের গঠন কার্যপদ্ধতি একই রকম।
ওমাটিডিয়ামের গঠনঃ
স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে প্রতিবিম্ব গঠনে সক্ষম পুঞ্জাক্ষির প্রতিটি সরলাক্ষি বা দর্শন একক বা একক আলােক সংবেদী অঙ্গকে ওমাটিডিয়াম বলে।
একটি ওমাটিডিয়াম ১০টি অংশ নিয়ে গঠিত। নিচে ঘাসফড়িংয়ের ওমাটিডিয়ামের গঠন বর্ণনা করা হলাে-
১। কর্নিয়া (Cornea)
এটি ওমাটিডিয়ামের বাহিরের দিকে অবস্থিত। এটি কিউটিকল নির্মিত ছয়কোণ বিশিষ্ট স্বচ্ছ আবরণ ।
কাজঃ কর্নিয়া লেন্সের মতাে কাজ করে ।
২। কর্নিয়াজেন কোষ (Corneagen cell)
কর্নিয়ার ঠিক নিচে একজোড়া কর্নিয়াজেন কোষ পাশাপাশি অবস্থান করে।
কাজঃ পুরাতন কর্নিয়া পরিত্যক্ত হলে এদের নিঃসৃত রসে নতুন কর্নিয়া সৃষ্টি হয় ।
৩। ক্রিষ্টালাইন কোণকোষ (Crystaline cone cell)
এগুলাে কর্নিয়াজেন কোষের নিচে অবস্থিত, লম্বা চারটি কোষ। এরা ক্রিষ্টালাইন কোণকে ঘিরে রাখে।
কাজঃ এসব কোষের নিঃসৃত রস দিয়ে ক্রিষ্টালাইন কোণ গঠিত হয় ।
৪। ক্রিস্টালাইন কোণ (Crystaline cone)
ক্রিস্টালাইন কোণকোষগুলাে দিয়ে পরিবেষ্টিত স্বচ্ছ, মােচাকৃতির অংশকে ক্রিস্টালাইন কোণ বলে।
কাজঃ এর মাধ্যমে আলােক রশ্মি প্রতিসরিত হয় ।
৫। আইরিশ রঞ্জক আবরণ (Iris pigment sheath)
কর্নিয়াজেন কোষ ও ক্রিস্টালাইন কোণ কোষগুলাে একটি । কালাে রঙের আবরণী দিয়ে আবৃত থাকে। একে আইরিশ রঞ্জক আবরণ বলে। তীব্র আলােকে এই আবরণী । প্রসারিত হয়ে কোণ কোষগুলােকে সম্পূর্ণরূপে আবৃত করে। আবার মৃদু আলোকে সংকুচিত হয়ে কোণ কোষগুলােকে আংশিক মুক্ত রেখে প্রতিবিম্ব গঠনকে প্রভাবিত করে।
৬। রেটিনুলার কোষ (Retinular cell)
এরা আকারে লম্বা এবং সংখ্যায় সাতটি। এদের নিউক্লিয়াস অগ্রপ্রান্তে অবস্থিত। এরা ক্রিস্টালাইন কোণ কোষের নিচে বৃত্তাকারে সাজানাে থাকে।
কাজঃ এদের নিঃসৃত রসে র্যাবড়ােম গঠিত হয়।
৭। র্যাবডোম (Rhabdom)
এটি রেটিনুলার কোষগুলাের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত লম্বা দণ্ডের মতাে অংশ । রেটিনুলার কোষ নিঃসৃত রসেই এটি গঠিত ।
কাজঃ র্যাবডম প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয় ।
৮। রেটিনাল সিথ (Retinal sheath)
এরা রঞ্জক কোষযুক্ত কালাে পর্দার আবরণী । এরা আইরিশ কোষের গােড়াকে এবং রেটিনুলার কোষকে বেষ্টন করে রাখে।
কাজঃ একটি ওমাটিডিয়ামকে তার পার্শ্ববর্তী ওমাটিডিয়াম থেকে পৃথক রাখে ।
৯। ভিত্তি পর্দা (Basal membrane)
ওমাটিডিয়াম যে পাতলা পর্দার ওপর অবস্থান করে তাকে ভিত্তি পর্দা বলে।
কাজঃ এটি ওমাটিডিয়াকে ধারণ করে।
১০। স্নায়ুতন্তু (Nerve fibre)
প্রতিটি রেটিনুলার কোষ থেকে স্নায়ুতন্তু বের হয়ে অপটিক স্নায়ুর সাথে যুক্ত থাকে।
কাজঃ এরা ওমাটিডিয়ামে সৃষ্ট প্রতিবিম্বকে মস্তিষ্ককে প্রেরণ করে ।
আলোর তীব্রতা অনুসারে পুঞ্জাক্ষীতে ২ ধরনের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়। যথাঃ
১. অ্যাপোজিশন প্রতিবিম্ব (Apposition image):
উজ্জ্বল আলোকে ঘাসফড়িং এর প্রতিবিম্ব গঠন পদ্ধতিকে এপপাজিশন বা মোজাইক প্রতিবিম্ব গঠন পদ্ধতিবলে। এই পদ্ধতিতে গঠিত প্রতিবিম্বকে অ্যাপোজিশন প্রতিবিম্ব বা মোজাইক প্রতিবিম্ব বলে।
প্রক্রিয়া
এ সময় ওমাটিডিয়ামের আইরিস পিগমেন্ট আবরণ প্রসারিত হয়ে র্যাবডোমগুলোকে সম্পূর্ণরূপে আবৃত করে। ফলে প্রতিটি ওমাটিডিয়াম পরস্পর হতে পৃথক হয়ে যায়। বস্তুর অংশ বিশেষ হতে আগত উলম্ব আলোকরশ্মিগুলো ওমাটিডিয়ামে প্রবেশ করে এবং যথাক্রমে কর্ণিয়া ও ক্রিস্টালাইন কোণ হয়ে র্যাবডোমে প্রবেশ করে। কিন্তু তীর্ষক আলোকরশ্মিগুলো কর্ণিয়ার মাধ্যমে প্রবেশ করলেও আইরিশ পিগমেন্ট আবরণ দ্বারা শোষিত হয়। ফলে প্রতিটি ওমাটিডিয়ামে পৃথক পৃথক প্রতিবিম্ব গঠিত হয়। এভাবে কয়েকটি ওমাটিডিয়াম একত্রে কোন বস্তুর আংশিক বা সম্পূর্ণ ও স্পষ্ট প্রতিবিম্ব গঠন করে। দিনের বেলা বা যে কোন সময় উজ্জল আলোতে এ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন প্রতিবিম্ব খুবই স্পষ্ট কিন্তু খন্ডিত হয়। এই প্রতিবিম্বকে মোজাইক প্রতিবিম্ব বা অ্যাপোজিশন প্রতিবিম্ব বলে।
২. সুপারপজিশন প্রতিবিম্ব (Superposition image):
স্তিমিত বা মৃদু আলোতে আরশোলার প্রতিবিম্ব গঠন পদ্ধতিকে সুপারপজিশন প্রতিবিম্ব গঠন পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতিতে গঠিত প্রতিবিম্বকে সুপারপজিশন প্রতিবিম্ব (Super Position) বলে।
প্রক্রিয়া
স্থিমিত বা মৃদু আলোকে ওমাটিডিয়ামের আইরিস পিগমেন্ট আবরণ কর্ণিয়ার দিকে এবং রেটিনুলার সীথ নীচের দিকে সংকুচিত হয়। ফলে র্যাবডোমের নীচের অংশ ও রেটিনুলার কোষের উপরের অংশ অনাবৃত হয়। বস্তু থেকে আগত উলম্ব আলোক রশ্মিগুলো এদের বরাবর অবস্থিত ওমাটিডিয়ামগুলোর কর্ণিয়া ও মোচার মধ্য দিয়ে র্যাবডোমে পৌছায়। কিন্তু তীর্যক রশ্মিগুলো কোন নির্দিষ্ট ওমাটিডিয়ামের কর্ণিয়ার মধ্য দিয়ে পার্শ্ববর্তী ওমাটিডিয়ামসমূহে প্রবেশ করে। ফলে কোন একটা ওমাটিডিয়ামের র্যাবডোমে বস্তুর একাধিক বিন্দু থেকে আগত আলোকরশ্মি পতিত হয় এবং সম্মিলিতভাবে একটি সামগ্রিক, অস্পষ্ট, ও ঝাপ্সা প্রতিবিম্ব গঠিত হয়। সাধারণতঃ রাতে বা যে কোন সময় স্তিমিত আলোতে ঘাসফড়িং এ প্রক্রিয়ায় দেখে। স্তিমিত আলোকে এই দর্শন প্রক্রিয়াকে সুপারপজিশন দর্শন বলে।
ঘাসফড়িং–এর প্রজননতন্ত্রঃ
ঘাসফড়িং একলিঙ্গ প্রাণী। পুরুষ হতে স্ত্রী ঘাসফড়িংকে তাদের ওভিপোজিটর (ovipositor) এবং উদরের পশ্চাৎ অংশ দেখে সহজেই সনাক্ত করা যায়।
ঘাসফড়িং এর পুং প্রজনন তন্ত্রঃ
একজোড়া শুক্রাশয় (testis, pl. testes) পুং প্রজনন তন্ত্রের প্রধান অঙ্গ। শুক্রাশয় ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম উদরীয় খন্ডকে অন্ত্রের উপরে অবস্থান করে। একটি মিডিয়ান লিগামেন্ট দ্বারা শুক্রাশয় পৃষ্ঠীয় প্রাচীরের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। প্রতিটি শুক্রাশয় ধারাবাহিকভাবে সজ্জিত লম্বাটে ক্ষুদ্র ফলিকল সমন্বয়ে গঠিত। শুক্রাশয়ে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় এবং তা শুক্রাশয় হতে অঙ্কীয় পার্শ্বীয় দিকে উত্থিত ভাস ডিফারেন্স (vas deferens) এ প্রবেশ করে। প্রতিটি ক্রাশয় হতে উত্থিত ভাস ডিফারেন্স নবম উদরীয় খন্ডে অন্ত্রের নিচে মিলিত হয়ে মধ্যরেখা বরাবর পেশিবহুল ক্ষেপন নালি (ejaculatony duct) গঠন করে। ভাস ডিফারেন্স এর শেষাংশ স্ফীত এবং সেমিনাল ভেসিকল (seminal vesicle) নামে পরিচিত। সেমিনাল ভেসিকল শুক্রাণু (spermatozoa) সঞ্চিত রাখে। একজোড়া সহায়ক গ্রন্থি (accessory glands) বা মাশরুম গ্রন্থি (mushroom glands) ক্ষেপন নালিতে উন্মুক্ত হয়। মাশরুম গ্রন্থি নিঃসৃত তরল পদার্থ শুক্রাণু স্থানান্তকরণে (স্ত্রী ঘাস ফড়িং-এ) সহায়তা করে। ক্ষেপন নালি পেনিস (penis) বা ইডেগাস (aedegus) এ উন্মুক্ত হয়।
ঘাসফড়িং এর স্ত্রী প্রজনন তন্ত্রঃ
স্ত্রী ঘাসফড়িং এ একজোড়া ডিম্বাশয় থাকে যা অন্ত্রের উপরে মিডিয়ান লিগামেন্ট (median ligament) দ্বারা পৃষ্ঠীয় প্রাচীরের সাথে আটকানো থাকে। প্রতিটি ডিম্বাশয় (ovary) লম্বাটে এবং ক্রমান্বয়ে সরু বেশ কতকগুলো ওভারিওলস (ovarioles) বা অণুডিম্বাশয় দ্বারা গঠিত। প্রতিটি ওভারিওল সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত বর্ধনশীল ডিম্বক বহন করে। ডিম্বনালি দুইটি একত্রিত হয়ে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ গঠন করে। একে যোনি (vagina) বলে। যোনি ওভিপজিটরের (ovipositor) মাধ্যমে বাহিরে উন্মুক্ত হয়। যোনির অদূরে অবস্থিত স্পার্মাথিকা (spermtheca) বা সেমিনাল রিসেপ্টেকল (secminal receptacle) হতে স্বতন্ত্র নালি যোনিতে উন্মুক্ত হয়। যোনির সাথে সংযুক্ত সহায়ক গ্রন্থি (accessory gland)কে কোল্যাটেরিয়াল গ্রন্থি (colleterial gland) বলে। কোল্যাটেরিয়াল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ ডিম পাড়ার পর ডিমগুলোকে একত্রে রাখতে সহায়তা করে। স্পার্মাথিকায় শুক্রাণু সঞ্চিত থাকে।
রূপান্তর (Metamorphosis)
"পতঙ্গের ভূণ যখন কয়েকটি ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ দশা প্রাপ্ত হয় তখন এ ধরনের ভ্রূণোত্তর পরিস্ফুটনকে রূপান্তর বলে। রূপান্তর প্রধানত দুধরনের- ১। অসম্পূর্ণ ও ২। সম্পূর্ণ রূপান্তর ।
১. অসম্পূর্ণ রূপান্তর (Incomplete metamorphosis) : (যে রূপান্তরে একটি পতঙ্গ ডিম ফুটে বেরিয়ে কয়েকটি নিক্ষ (শিশু)দশা অতিক্রমের পর পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গে পরিণত হয় তাকে অসম্পূর্ণ রূপান্তর বলে। প্রত্যেক নিম্ফ দশা দেখতে প্রায় পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গের ক্ষুদ্র প্রতিরূপের মতো দেখায়, কিন্তু এগুলো ডানা ও জননাঙ্গবিহীন থাকে এবং স্পষ্ট বর্ণপার্থক্য প্রদর্শন করে। অসম্পূর্ণ রূপান্তরের শিশু অবস্থায় প্রাণীকে নিম্ফ (nymph) বলে। উদাহরণ- ঘাসফড়িং ও তেলাপোকার রূপান্তর।
২. সম্পূর্ণ রূপান্তর (Complete metamorphosis) : যে রূপান্তরে শিশু প্রাণী ও পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর মধ্যে কোনো আঙ্গিক মিল থাকে না এবং ব্যাপক পরিবর্তনের মাধ্যমে শিশুপ্রাণী পূর্ণাঙ্গ অবস্থাপ্রাপ্ত হয়, সে ধরনের রূপান্তরকে সম্পূর্ণ রূপান্তর বলে। এ ক্ষেত্রে রূপান্তরের ৪টি সুস্পষ্ট ধাপ হচ্ছে ডিম লার্ভা পিউপা →ইমোগো (পূর্ণাঙ্গ)” সম্পূর্ণ রূপান্তরে শিশু অবস্থায় প্রাণীকে লার্ভা (larva) বলে। উদাহরণ- মৌমাছি ও প্রজাপতির রূপান্তর ।
ঘাসফড়িং-এর রূপান্তর অসম্পূর্ণ বা হেমিমেটাবোলাস (hemimetabolous) ধরনের কারণ এদের অপরিণত নিম্ফ আংশিক পরিস্ফুটনের মাধ্যমে কয়েকটি নিম্ফ দশা পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ ঘাসফড়িং-য়ে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ ঘাসফড়িংয়ের জীবন ইতিহাসে তিনটি ধাপ রয়েছেঃ ডিম → নিম্ফ পূর্ণাঙ্গ প্রাণী ।
ডিম ফুটে যে তরুণ ঘাসফড়িং বেরিয়ে আসে তাকে নিম্ফ (nymph) বলে )নিম্ফে ডানা ও জননাঙ্গ থাকে না,সদ্য পরিস্ফুটিত নিম্ফের কাইটিন নির্মিত বহিঃকঙ্কাল থাকে স্বচ্ছ, ক্রমশ গাঢ় হয়। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের ও নিম্ফ একটু বড় হলে বহিঃকঙ্কাল আঁটসাট হয়ে দেহবৃদ্ধি রহিত করে দেয়। তখন দেহবৃদ্ধি স্বাভাবিক রাখতে পুরনে বহিঃকঙ্কাল মোচন বা মোল্টিং (molting) প্রক্রিয়ায় ত্যাগ করে ২য় ধাপের নিম্ফে পরিণত হয় । পরবর্তীতে আরও ৩ বার খোলস মোচনের পর পূর্ণাঙ্গ ঘাসফড়িং-এ রূপান্তরিত হয়। দ্বিতীয় ধাপের নিম্ফে ক্ষুদ্রাকায় ডানা প্যাড (wing pad) থেকে ডানা সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটে । প্রতিবার খোলস মোচনের পর নিম্ফ দেখতে পূর্ণাঙ্গ ঘাসফড়িং-এর মতো দেখায়। তা ছাড়া এদের পরিস্ফুটনে কোনো বিশ্রাম দশাও নেই। পঞ্চম বার খোলস মোচনের মাধ্যমে নিম্ফ পরিণত ঘাসফড়িং হয়ে উঠে দুটি মোচনের মধ্যবর্তী দশাকে ইনস্টার (instar) বলে । ঘাসফড়িং-এর রূপান্তর সম্পন্ন হতে প্রায় দুমাস সময় লাগে।
রূপান্তরে হরমোনের ভূমিকাঃ
ঘাসফড়িং-এর সুষ্ঠু রূপান্তরে বিভিন্ন হরমোনের মিথস্ক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মস্তিষ্কের কিছু অংশে এবং স্নায়ুরজ্জুর গ্যাংগলিয়া বিভিন্ন স্নায়ু-সংবেদী, হরমোন উৎপন্নকারী কোষ বহন করে। এসব কোষ প্রোথোরাসিকোট্রপিক হরমোন (PTTH) উৎপন্ন করে। মস্তিষ্কের পেছনে কর্পোরা অ্যালাটা নামে একজোড়া অংশে স্নায়ু- সংবেদী কোষগুলোর অ্যাক্সন প্রেরিত হয়। কর্পোরা অ্যালাটা PTTH জমা ও ক্ষরণ করে এবং জুভেনাইল হরমোন (juvenile hormone) নামে এক ধরনের হরমোন উৎপন্ন করে। PTTH হিমোলিম্ফের মাধ্যমে প্রোথোরাসিক গ্রন্থিতে বাহিত হয় । এ গ্রন্থি PITH-এর প্রতি সাড়া দিয়ে একডাইসন (ccdysone) বা মোচন হরমোন (molting hormone) উৎপন্ন করে। একভাইসনের প্রভাবে মোচন ক্রিয়া শুরু হয় এবং পুরনো কিউটিকল মোচিত হয় (এ প্রক্রিয়ার নাম একডাইসিস)
সম্পূর্ণ রূপান্তর
অসম্পূর্ণ রূপান্তর
মেটাবোলাস
গেমিমেটাবোলাস
Read more